তিলাওয়াত

তিলাওয়াত (আরবি: تِلَاوَة) একটি আরবি শব্দ, যার মূল অর্থ হচ্ছে পাঠ করা, আবৃত্তি করা, অনুসরণ করা বা অনুধাবন করা। ইসলামিক পরিভাষায়, তিলাওয়াত বলতে বিশেষভাবে আল-কুরআন-এর আয়াতসমূহ বিশুদ্ধ উচ্চারণ (তাজবীদ) এবং সুরেলা আবৃত্তির সাথে পাঠ করাকে বোঝায়। এর সাথে কুরআনের অর্থ গভীরভাবে অনুধাবন করাও এর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

তিলাওয়াত শুধু মুখে পাঠ করা নয়, এটি একটি ইবাদত এবং আল্লাহর বাণীর সাথে আধ্যাত্মিক সংযোগ স্থাপনের মাধ্যম। এর মাধ্যমে মুসলমানরা আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ করে এবং কুরআনের শিক্ষা ও নির্দেশনা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করে।

কুরআন তিলাওয়াতের কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো:

তাজবীদ: কুরআন পাঠের ক্ষেত্রে সঠিক উচ্চারণ, অক্ষরের মাখরাজ, গুন্নাহ, মাদ ইত্যাদি নিয়মকানুন মেনে চলা অত্যাবশ্যক। সঠিক তাজবীদ ছাড়া তিলাওয়াত করলে অর্থের বিকৃতি ঘটতে পারে।
তর্তীল: শান্তভাবে, ধীরস্থিরভাবে ও সুন্দর সুরের সাথে কুরআন তিলাওয়াত করাকে তর্তীল বলে। এতে পাঠক ও শ্রোতা উভয়ই কুরআনের অর্থ ও বাণীর গভীরতা উপলব্ধি করতে পারেন।
তাফাক্কুর (অনুসন্ধান/চিন্তাভাবনা): তিলাওয়াতের সময় কুরআনের আয়াতসমূহের অর্থ ও উদ্দেশ্য নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করা। এটি আত্মিক পরিশুদ্ধি ও আল্লাহ তায়ালার প্রতি বিশ্বাস বৃদ্ধির জন্য অত্যন্ত জরুরি।
আমল: কুরআন শুধু পাঠের জন্য নয়, এর নির্দেশনা অনুযায়ী জীবনযাপন করাও তিলাওয়াতের একটি অপরিহার্য অংশ।
তিলাওয়াত মুসলিমদের জীবনে শান্তি ও আত্মিক প্রশান্তি এনে দেয়। এর মাধ্যমে আল্লাহর রহমত ও বরকত লাভের সুযোগ হয়।

তিলাওয়াত করার ভাল সময় কখন?

কুরআন তিলাওয়াতের নির্দিষ্ট কোনো সময় নেই; দিনে-রাতে, নামাজের আগে-পরে যেকোনো সময়ই কুরআন তিলাওয়াত করা যায়। তবে কিছু সময় আছে যখন তিলাওয়াত করলে তুলনামূলক বেশি ফজিলত এবং আল্লাহর কাছে অধিক পছন্দনীয় বলে বিবেচিত হয়। নিচে কিছু উত্তম সময়ের উল্লেখ করা হলো:

১. ফজরের সময় (ফজরের নামাজের পর): এটি কুরআন তিলাওয়াতের জন্য সবচেয়ে ফজিলতপূর্ণ সময়গুলোর একটি। আল্লাহ তায়ালা কুরআনে বলেছেন: “সূর্য ঢলে পড়ার সময় থেকে রাত্রির অন্ধকার পর্যন্ত নামাজ কায়েম করুন এবং ফজরের কোরআন পাঠও। নিশ্চয় ফজরের কোরআন পাঠ মুখোমুখি হয়।” (সূরা বনি-ইসরাঈল: আয়াত ৭৮) এই আয়াত থেকে বোঝা যায় যে, ফজরের সময় কুরআন তিলাওয়াত ফেরেশতাগণ দ্বারা সাক্ষ্য হয়। অর্থাৎ, দিবা ও রাত্রির ফেরেশতারা এই তিলাওয়াত দেখেন। এই সময়টা সাধারণত শান্ত ও নিরিবিলি থাকে, যা একাগ্রতার সাথে তিলাওয়াতের জন্য খুব সহায়ক।

২. তাহাজ্জুদের সময় (রাতের শেষ প্রহর): রাতের শেষ তৃতীয়াংশ বা তাহাজ্জুদের সময়ও কুরআন তিলাওয়াতের জন্য অত্যন্ত উত্তম। এই সময় মানুষ জাগতিক ব্যস্ততা থেকে মুক্ত থাকে এবং আল্লাহর সাথে একান্তে সম্পর্ক স্থাপনের সুযোগ পায়। এই সময়ে তিলাওয়াত করলে মন ও মস্তিষ্ক অত্যন্ত সতেজ থাকে, ফলে কুরআনের অর্থ অনুধাবন করা সহজ হয়।

৩. মাগরিব ও ইশার নামাজের পর: মাগরিব ও ইশার নামাজের পর কুরআন তিলাওয়াত করাও ফলপ্রসূ। দিনের কাজ শেষ করে এই সময়ে ধীরস্থিরভাবে তিলাওয়াতের সুযোগ পাওয়া যায়, যা আত্মিক প্রশান্তি নিয়ে আসে।

৪. ঘুমের পূর্বে: ঘুমানোর আগে কুরআন তিলাওয়াত করা একটি বরকতপূর্ণ অভ্যাস। এটি মনকে শান্ত করে এবং দিনের ভুলত্রুটির জন্য ক্ষমা চাইতে সাহায্য করে।

৫. যেকোনো সময়: যদিও উপরোক্ত সময়গুলো বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, তবুও একজন মুসলিম দিনের যেকোনো সময়ই কুরআন তিলাওয়াত করতে পারে। যখনই সুযোগ পাওয়া যায়, তখনই কুরআন পাঠ করা উচিত। আল্লাহ তায়ালা নিজেই বলেছেন, “এবং কুরআন তেলাওয়াত করুন সুবিন্যস্ত ভাবে ও স্পষ্টভাবে।” (সূরা মুজ্জাম্মিল: ৪)।

গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, তিলাওয়াতের সময় মনোযোগ সহকারে এবং তাজবীদের নিয়মাবলী মেনে পাঠ করা। শুধু মুখে পাঠ করা নয়, এর অর্থ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা এবং এর নির্দেশনাবলী জীবনে বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করা উচিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *